ঢাকা, বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৭ পৌষ ১৪৩২ | ১০ রজব ১৪৪৭

শিরোনাম

পিট ভাইপার বা বোড়া সাপ কতটা বিষধর?

পিট ভাইপার বা বোড়া সাপ কতটা বিষধর?

কয়েক মাস আগে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয় পিট ভাইপার নামের একটি বিষধর সাপ- সেসময় খবরটি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।বাংলাদেশে এই সাপটি সবুজ বোড়া নামেই বেশি পরিচিত। সাপ উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব বলেছেন, পাহাড় থেকে কেটে আনা কলার ছড়ি বাজারে বিক্রি করতে আনার পর এর ভেতর থেকে সাপটি বেরিয়ে এলে সেসময় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বাজারে। পরে ফাউন্ডেশনে খবর দেয়া হলে তারা গিয়ে সবুজরঙা সাপটিকে উদ্ধার করে বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে লাউয়াছড়া উদ্যানে সাপটিকে অবমুক্ত করে বনবিভাগ। এ ঘটনার পর সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমে পিট ভাইপার নিয়ে নানা ধরনের আগ্রহ দেখা গেছে। সাপটি কতটা বিষধর কিংবা প্রাণঘাতী কি-না, এমন নানা প্রশ্নও উঠে আসে আলোচনায়।

  • পিট ভাইপার বা সবুজ বোড়া কেমন সাপ? কী পরিচয়?

প্রাণীবিদেরা বলছেন, পিট ভাইপার মূলত মধ্যম মাত্রার বিষধর সাপ। এটি ভিপারিডি পরিবারের ক্রোটালিনি উপপরিবারের অন্তর্গত। পিট ভাইপার নামটি এসেছে এদের চোখ ও নাকের মাঝখানে অবস্থিত পিট নামক দুটি তাপ-সংবেদনশীল অঙ্গের কারণে। এর ভেতরে একটি পাতলা ঝিল্লি থাকে, যা অপটিক নার্ভের মাধ্যমে সরাসরি মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত। সামনে মুখ করা এ দুইটি অঙ্গের মাধ্যমেই পিট ভাইপার শিকারের শরীরের উষ্ণতা থেকে মস্তিষ্কের ভেতরে এর ছবি তৈরি করতে পারে এবং অন্ধকারের মধ্যেও উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট শিকারের অবস্থান ও দূরত্ব নিখুঁতভাবে নিশানা করে আঘাত করতে পারে।

এদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এরা বিষদাঁত দুটো কেবল প্রয়োজন পড়লেই বাইরে বের করে। অন্য সময় এগুলো মুখের ভেতরের দিকে ভাঁজ করে রাখতে পারে। পিট ভাইপার ৯০ থেকে ১৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে কোনো কোনো প্রজাতির দৈর্ঘ্য দুই মিটার পর্যন্তও হতে পারে। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্র্রিটানিকার তথ্যমতে, মরুভূমি থেকে শুরু করে রেইনফরেস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন পরিবেশে পিট ভাইপার পাওয়া যায়।

বাংলাদেশে ১২০টি প্রজাতির সাপের তালিকা করার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মোঃ আবু সাইদ। তালিকার ১০৭টি প্রজাতির সাপের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসানের সঙ্গে মিলে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩৫টি প্রজাতির সাপ বিষধর, আর ৮৫টি প্রজাতি বিষধর নয়। এই বিষধরের তালিকায় আছে পিট ভাইপারও। তবে পিট ভাইপারের কামড়ে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর রেকর্ড পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম ফরিদ আহসান।

আবু সাইদ বলছেন, বাংলাদেশে সাত প্রজাতির পিট ভাইপার পাওয়া যায়। এরমধ্যে ছয়টি প্রজাতি নিশ্চিত করা গেছে এবং আরেকটি প্রজাতি আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এগুলো হলো- পাহাড়ি বোড়া – চায়নিজ মাউন্টেন পিট ভাইপার বা পাহাড়ি বোড়া নামে পরিচিত। জার্ডন পিট ভাইপার। হোয়াইট লিপ পিট ভাইপার – বাংলায় একে বলা হয় সাদা ঠোঁট সবুজ বোড়া। স্পট টেইল পিট ভাইপার – তিলালেজি সবুজ বোড়া। এই প্রজাতির পিট ভাইপার সবুজরঙা হয়, তবে লেজের দিকটি হয় বাদামি রঙের। একারণে এটিকে ডাকা হয় তিলালেজি। ব্যাম্বো পিট ভাইপার – বাংলায় বলা হয় বাঁশ বোড়া। পপস পিট ভাইপার বা পোপের সবুজ বোড়া। ম্যানগ্রোভ বা পার্পল স্পটেড পিট ভাইপার – বেগুনি বা তিলালেজী। শ্রীমঙ্গল থেকে যে সাপটি পাওয়া গেছে, সেটি স্পট টেইল পিট ভাইপার বা তিলালেজি সবুজ বোড়া প্রজাতির ছিল।

সাপটির বর্ণনা দিতে গিয়ে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনের পরিচালক স্বপন দেব বলেন, আড়াই ফিতের মতো লম্বা সবুজরঙা সাপটির গায়ে সাদা রঙের ফোঁটা ফোঁটা ছিল। লেজের শেষের দিকের ছয় থেকে সাত ইঞ্চি ছিল বাদামি রঙের। সাপটির মাথা ছিল চ্যাপ্টা প্রকৃতির, আর গলার নিচের অংশ ছিল সাদা। আর এই সাত প্রজাতির মধ্যে জর্ডানস পিট ভাইপার প্রজাতি বাংলাদেশে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

  • অন্ধকারেও বুঝতে পারে শিকারের অবস্থান

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্য প্রজাতির সাপের মতো গ্রামাঞ্চলের ঝোপঝাড়ে পিট ভাইপার খুব একটা দেখা যায় না। সাধারণত বন ও পাহাড়ি অঞ্চলেই এই প্রজাতির সাপ বেশি দেখা যায়। আবু সাইদ বলছেন, আমাদের দেশের চট্টগ্রাম, সিলেটের যে বনাঞ্চলগুলো আছে, আমাদের সুন্দরবনে, কোস্টাল জোন (উপকূলীয় এলাকা), পাহাড়ি অঞ্চলে পিট ভাইপার থাকে। ফলে সুন্দরবন, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি অঞ্চলেই মানুষজনকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিট ভাইপারের কামড় খেতে দেখা যায়। পিট ভাইপার যেকোনো জায়গায় দংশন করতে পারে। যেহেতু এরা গাছে থাকে, আপনি হয়তো গাছের নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, আপনার মাথার, ঘাড়ে, চোখে বাইট করলো। যেকোনো জায়গায় কিন্তু পিট ভাইপার কামড় দিতে পারে। পিট ভাইপার মূলত নিশাচর প্রাণী। অর্থাৎ রাতের বেলাতেই এরা বেশি চলাফেরা করে। আর বেশিরভাগ সময় এটি গাছে থাকে। অন্ধকারের মধ্যেও শিকারের অবস্থান ও দূরত্ব নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করে আঘাত করতে পারে।

  • উপসর্গ ও চিকিৎসা

পিট ভাইপারের বিষ হলো হেমোটক্সিন। এটি এমন একটি বিষাক্ত উপাদান, যা সুস্থ লাল রক্তকণিকা ধ্বংস করতে পারে। এর ফলে রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা তৈরি হয় এবং এটি রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা ও পেশি টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এটি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে রক্তক্ষরণ, টিস্যু ভেঙে ফেলা, এবং রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা সৃষ্টি করে। বেসরকারি সংস্থা ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশন বলছে, পিট ভাইপারের কামড়ে বাংলাদেশে মৃত্যুর ঘটনা দেখা না গেলেও চিকিৎসা নিতে দেরি হলে আক্রান্ত ব্যক্তি অঙ্গহানি করতে হতে পারে। পিট ভাইপার কোনো ব্যক্তিকে কামড় দেয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে আক্রান্ত স্থানটি প্রচণ্ড ফুলে যায় এবং যন্ত্রণা বোধ হয়।

আবু সাইদ বলছেন, সাধারণত পিট ভাইপার যখন কামড় দেয়, আশেপাশে তাৎক্ষণিক জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। প্রচণ্ড ব্যথা হয়, ফুলে যায়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জায়গাটি অস্বাভাবিক পরিমাণে ফুলে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থানের রঙ বদলে নীলচে বা কালো বর্ণ ধারণ করতে পারে এবং অনেক সময় ফোসকা পড়ে যায়।

পিট ভাইপারের কামড়ে ত্বকে এক, দুই বা তিনটি ছিদ্রের চিহ্ন থাকতে পারে, তবে অনেক সময় কোনো দাগ দেখা নাও যেতে পারে। এছাড়া আরাে যেসব উপসর্গ দেখা যেতে পারে- তীব্র ও তাৎক্ষণিক ব্যথা এবং দ্রুত ফুলে যাওয়া। চামড়ায় কালশিটে দাগ বা রক্তজমাট। শ্বাস নিতে অসুবিধা। হার্টবিটের গতি বা ছন্দে পরিবর্তন। মুখে ধাতব, রাবার মতো বা মিন্টের স্বাদ অনুভব। মুখ, জিহ্বা, মাথার তালু, পা বা কামড়ের জায়গায় ঝিনঝিনে বা অবশভাব। কামড়ের কাছাকাছি লিম্ফ নোডে ফুলে যাওয়া। শকে চলে যাওয়ার মতো লক্ষণ।

এই উপসর্গগুলো সাধারণত ছােবল দেয়ার কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেখা দিতে পারে। এছাড়াও ভয় বা মানসিক চাপ থেকেও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া বা অজ্ঞানভাব হওয়া, ঘাম হওয়া ও শীতল অনুভব করা, বমি বমি ভাব বা বমি করা এবং দুর্বলতা বা মাথা ঘোরার মতো কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে এসব উপসর্গের তীব্রতা নির্ভর করে সাপের প্রজাতি, কতটা বিষ শরীরে প্রবেশ করেছে এবং ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর।

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আবু সাইদ জানান, গ্রিন পিট ভাইপারের কোনো এন্টিভেনম বাংলাদেশে নেই। থাইল্যান্ডে এর মনোভ্যালেন্ট এন্টিভেনম পাওয়া যায়। সেখান থেকে কিছু এন্টিভেনম এনে বাংলাদেশে ট্রায়াল দেয়া হয়েছিল। তবে সাপ কামড় দিলেই এন্টিভেনম দেয়া হয় না। তারা (চিকিৎসকরা) সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট করে। বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক কিংবা পেইনকিলার বা এসব ওষুধ দিয়ে তারা এটার ট্রিটমেন্ট করে।