ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১৫ আশ্বিন ১৪৩২ | ৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

প্রবহমান নদী বাংলাদেশের প্রাণ / শহিদুল ইসলাম ফারুক

প্রবহমান নদী বাংলাদেশের প্রাণ / শহিদুল ইসলাম ফারুক

ফাইল ছবি

রবীন্দ্রনাথের কবিতায়-
“ওরে তোরা কি জানিস কেউ
জলে উঠে কেন এত ঢেউ।
ওরা দিবস-রজনী নাচে,
তাহা শিখেছে কাহার কাছে।"

চাকরির সুবাদে একদা অবসরে একটি ছোট নদীর তীরে বসে আড্ডা দিতাম। গদ্য-পদ্য জানা নেই তাই সে অনুভূতির ভাব প্রকাশের ভাষা নেই কিন্তু নিরন্তর বয়ে চলা সে নদীর কুলু কুলু ধ্বনি এখনো কানে ঝঙ্কার তোলে। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে অনেক দূরে মেঘনা নদী।সে কারণে নদীর সাথে আমার সখ্য, কলহ বা শত্রুতা কোনটাই নেই। পঞ্চাশের দশকে নোয়াখালী শহর গিলে খাওয়ার সময় ভয়ঙ্কর আগ্রাসী মেঘনা চলে এসেছিল প্রায় বাড়ীর পাশে । স্বেচ্ছায় এসে তান্ডব চালিয়ে , হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব করে, ভিটামাটি এমনকি পুরো শহর উদরস্ত করে আবার মাত্র কয়েক বছর পর ফিরে গেছে প্রায় ৪০ কিমি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোলে। চাকুরীর সুবাদে ’৭৮-৭৯ সালে টেকনাফ থেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে কয়েকবার সেন্টমার্টিন ভ্রমণ , ঢাকা ও ফরিদপুর যাতায়াতে ফেরী পারাপার আর ছুটির দিনে সদরঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে বুড়িগঙ্গায় বিকাল-সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ একা একা বেড়ানো এই হলো মোটামুটি আমার নদীর অভিজ্ঞতা। বাকী যেটুকু জানি তা কবিতা, ছড়া ও উপন্যাস পড়ে আর টেলিভিশনে খবর দেখে । একদিকে ভয়াল রাক্ষুসী রূপে, অন্যদিকে তীরে বসবাসকারী মানুষের অন্ন সংস্থানের মাধ্যমে ধরা দেয় নদী। কখনো আক্রশে গিলে খাচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি,জমিজমা, কখনো আবার বয়ে চলে শান্ত নব বধূর মত। নদী নিয়ে সম্প্রতি অনেক কথাবার্তা জ্ঞানগর্ব আলোচনা হচ্ছে, বিশেষ করে পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর পদ্মার একচ্ছত্র দখল বলা চলে । কবি- সাহিত্যিক, পানি ও নদী বিশেষজ্ঞরা নদীর সৌন্দর্য, রূপ,গর্জন,ভাঙ্গা-গড়া, অবদান নিয়ে কাব্যিক ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করছেন হরহামেশা। একটা গল্পে- এক স্কুল ছাত্রকে শিক্ষক যে রচনাই লিখতে দেন, সে ঘুরে ফিরে নদীতে চলে আসে এবং কুমিরের বর্ণনা দিতে থাকে । সে গল্পটা অবশ্য বিনোদন বৈকি।
আভিধানিক ভাবে নামের কারণে নদ-নদী পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ। পৃথিবীর আদি সভ্যতা ও মানুষের বসতি ছিল নদী কেন্দ্রিক। নদী তীরেই গড়ে উঠেছিল ইরাকের টাইগ্রিস-ইউপ্রেটিস, সিন্ধু নদ কেন্দ্রিক হরপ্পা ও মহেনজোদারো ।মিশরকে বলা হয় নীল নদের দান, চীনের দুঃখ হোয়াংহো । ঢাকা গড়ে উঠেছিল বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে যদিও বর্তমান বিস্তৃত ঢাকা চার নদী বেষ্টিত, বাণিজ্য নগরী চট্রগ্রাম কর্নফুলি নদীর এবং নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যার তীরে. বরিশাল কীর্তনখোলা নদীর তীরে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ গৌড় নগরী যমুনার তীরে গড়েছিল আবার যমুনা সরে যাওয়ার পর সে নগরী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। লন্ডন শহর টেমস নদীর তীরে । পাকিস্তানের রয়েছে সিন্ধু, ঝেলাম, চেনাব, রাবি, বিয়াস ও শাটলেস । ভারতের গঙ্গা বাংলাদেশে এসে পদ্মা নাম ধারণ করে চলে গেছে সাগরপানে। এক কালের পূর্ণ যৌবনা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র এখন প্রায় মৃত অথচ তার থেকে বয়ে যাওয়া একটি ছোট খাল এখন প্রবল প্রমত্ত তেজস্বী যমুনা । 

পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ হাজারো নদ-নদীর গভীর আনুকূল্যে পলিবিধৌত নদীমাতৃক আমাদের সোনার বাংলাদেশ ।প্রবহমান নদী আমাদের বাংলাদেশের প্রাণ। মাছ , চাষাবাদের কাজে, যাতায়াত , আমদানি-রফতানি সুবিধা করেছে মানুষকে নদী কেন্দ্রিক । নদীকে কেহ বলেন দরিয়া আবার কেহ বলেন গাং বা গাঙ । কেহ বলে থাকেন গঙ্গা থেকে হয়েছে গাং। কবি সাহিত্যিকেরা আবার স্রোতস্বিনী, কল্লোলিনী, সর্পিল , সুন্দরী ললনা ইত্যাদি নানান কাব্যিক বিশেষণে বিশেষিত করে তোলেন। মানুষের সাথে নদ-নদীর যেমন সখ্যতা রয়েছে তেমন রয়েছে বৈরীতাও । সুখ-দূঃখ,হাসি- কান্নার অমর গাঁথা বুকে নিয়ে অবিরাম ছুটে চলে এসব নদ- নদী উৎস থেকে মোহনায়। নদ নদীর উৎস সাধারণত সুউচ্চ পার্বত্য অঞ্চল । হাজার হাজার ফুট উঁচু পর্বতের বরফগলা ও বৃষ্টির পানি ঢাল বেয়ে প্রবল স্রোতস্বিনীর মাধ্যমে সৃষ্টি করে নদ- নদী। নদীর জন্ম যেখানেই হোক ছুটে চলে সাগরপানে । দু-তিনটি স্রোতস্বিনী সৃষ্টি করে একটি নদী। কাহারও থাকে উপ ও শাখা নদী। উৎসে নদী থাকে পূর্ণ যৌবনা, প্রবল স্রোতা এবং চালায় ব্যাপক খনন কাজ । ধীরে ধীরে বয়ে চলে আর ক্রমে শক্তি ক্ষয় করে এক সময় সাগরে পড়ে তার মৃত্যু ঘটে । আমাদের দেশের অধিকাংশ নদীর উৎপত্তি ভারতে। একমাত্র ব্রহ্মপুত্র এসেছে তিব্বত থেকে। কয়েকটি ছোট নদী মায়ানমার ও ভুটান থেকেও প্রবেশ করেছে এদেশে। কাল-কালান্তরে নদ-নদী নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য উপন্যাস , কবিতা , ছড়া ও ছোট গল্প । যেমন- মানিক বন্দ্যােপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। তিতাস একটি নদীর নাম , নদী ও নারী, বরফ গলা নদী, আমাদের ছোট নদী, সোনার তরী, ইছামতি, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, কেয়া পাতার নৌকা, নদীতে নৌকা ডুবির ঘটনা থেকে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘নৌকা ডুবি’। এছাড়া ‘মেঘনা পাড়ের ছেলে আমি মেঘনা নদীর নেয়ে, ইচ্ছা হলে এপার থেকে ওপার দেই পাড়ি’ এমন অনেক কবিতা ও উপন্যাস রয়েছে । আবার পদ্মা পাড়ের পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের রয়েছে অনেক কবিতা বিশেষ করে তাঁর রচিত নাটক ‘ নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ অনবদ্য। জীবনানন্দ তাঁর রচনায় এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপাল কুন্ডলা’সহ কিছু উপন্যাসে নদীর উল্লেখ করেছেন প্রায়শই । নদী নিয়ে আব্বাস উদ্দিন, আবদুল আলীম, ফেরদৌসি রহমান, নীনা হামিদসহ ভারতীয় শিল্পীরা কত গান যে রচনা করেছেন ও গেয়েছেন তার হিসেব করা বলতে গেলে অসম্ভব । "ও নদীরে একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে, পদ্মার ঢেউরে,সর্বনাশা পদ্মা নদীরে, আমায় ভাসাইলিরে আমার ডুবাইলিরে, নদীর কূল নাই কিনার নাই , মাঝি বাইয়া যাওরে, কল কল ছল ছল নদী করে টল মল, কর্ণফুলির মাঝি অ্যাঁই তোরা কন কন যাবি অ্যাঁর সাম্পানে" সহ এমন হাজারো আবেদনময়ী গানে সমৃদ্ধ হয়েছে নদ-নদীকে উপজিব্য করেই। নদী নিয়ে গীত বাংলার গানের ভুবন এখন সমৃদ্ধ। নদী নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ যেনো পদ্মাসেতু নির্মাণের পর আরো বেড়ে গেছে সহস্রগুণ। নদী পাড়ে না গেলে সে আবেগ প্রকৃতই অনুভূত হয় না যেমন, তেমনি আবার সমুদ্রতীরে না গেলে এর বিশালতা অনুভূত হয় না। নদী পথেই এই বাংলায় আগমন ঘটেছে পর্তুগীজ,মগ,বৃটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানীসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জলদস্যুর । যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নদী হওয়ায় মোগল–বৃটিশ শাসকেরা শাসন কাজে নৌ পথে ঢাকায় আসতেন । কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার জন্য পদ্মা-গড়াই পাড়ি দিয়ে নৌকায় আসতেন শিলাইদহ, শাহবাজপুর, পতিসরসহ বিভিন্ন কুটিবাড়ী ও কাচারি বাড়িতে । কলকাতা থেকে ঢাকা ও বরিশাল অঞ্চলে যাতায়াত ছিল নদীপথে গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে । সেকালে হজ্জ যাত্রীরা এই গোয়ালন্দ –কলকাতা- বোম্বে হয়ে মক্কা-মদীনায় হজ্জে যেতেন । নদীর পাড়ে স্টিমার গুলোকে বলা হতো মেল। যেমন ঢাকা মেল, বরিশাল মেল ইত্যাদি। কালক্রমে স্টিমার ও নৌকার পরে এসব নদীতে ফেরী চালু হয়ে পারাপার হতে থাকে যান্ত্রিক যানবাহন। ফেরীঘাটে সুস্বাদু তাজা ইলিশ আর গরম ভাতের বর্ণনা অনেকেই দিয়ে থাকেন । আবার ফেরীঘাটে যেমন ছিল খাওয়ার স্বাদ, তেমনি বিস্বাদ ছিল ফেরিওয়ালাদের উৎপাত। আধুনিক প্রযুক্তির ব্রীজ , কালভার্ট নির্মাণের ফলে ফেরী পারাপার কর্মযজ্ঞ কমে গিয়ে কর্মহীন হচ্ছে ফেরী ও ফেরীওয়ালারা। বন্ধ হচ্ছে ফেরীঘাটের নিত্যচেনা হাঁকডাক ও হৈ চৈ মুখর জীবনের গতি । 
নদ-নদী চলছে, চলবে প্রকৃতির চিরন্তন ধারায়। কিন্তু প্রকৃতির এই ধারায় বাদসাধে কিছু মানুষরূপী কুলাঙ্গার, সন্ত্রাসী। তারা নদী দখল, খাল দখল করে তৈরি করছে নিজস্ব স্থাপনা ও ব্যক্তিগত ব্যবসাকেন্দ্র। এইসব দখলবাজ সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে মরে গেছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের অনেক নদী ও খাল। যার কারণে নিত্য লেগে আছে বন্যা, খরা ও জলাবদ্ধতা।ফসলের জমি হয়ে পড়েছে শুষ্ক। মাটির নীচে পানির স্তর নেমে গেছে বিপজ্জনক ভাবে। চাষাবাদে দেখা দিয়েছে মন্দা। 

দখলবাজদের অত্যাচারে নদীগুলো গতি হারানোর ফলে নদীপাড়ের বসবাসকারী মানুষের চীরকালের নদী নির্ভর অন্ন সংস্থানের পথও বন্ধ হচ্ছে বেশুমার। তাই প্রাণ বাঁচানোর প্রয়োজনে, জীবনের প্রয়োজনে নদী বাঁচাতে হবে সর্বাগ্রে। উচ্ছেদ আর নির্মূল করতে হবে সন্ত্রাসী, দখলবাজ নদী-খাল-জলাশয় খেকোদের। উদ্ধার করতে হবে দখল করা সব নদী খাল ও জলাশয়। আবার প্রবহমান গতি নিয়ে ফিরে আসুক বাংলাদেশে এককালের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণ ধোলাই খাল, চাকতাই খাল , ধানমন্ডি খাল ,নোয়াখালী খালসহ দেশের আনাচে-কানাচে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা সকল নদী-খাল ও জলাশয়সমূহ। নদীর একূল ভাঙ্গে ঐকূল গড়ে এইতো নদীর খেলা। প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে নদী ভাঙবে আবার গড়বে, তাই বলে কলহ করা যাবে না নদীর সাথে। দখল করা যাবেনা নদী। 

পরিশেষে প্রখ্যাত কথাশিল্পী ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্রনাথ’ উপন্যাসের মূল চরিত্র সরযু’র বিখ্যাত উক্তি- “যাহার প্রাসাদতূল্য অট্রালিকা নদীগর্ভে ভাঙ্গিয়া পড়ে সে আর খানকতক ইট বাঁচাইবার জন্য নদীর সাথে কলহ করিতে চাহেনা”। আমরাও চাইনা নদীর সাথে কলহ করিতে।”

শহিদুল ইসলাম ফারুক : লেখক ও কলামিস্ট।