ছোটদের কাছে চিপসের মতো স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার সবসময়েই লোভনীয়। কিন্তু তার পাশাপাশি আরেকটি প্যাকেট-জাত স্ন্যাক্সের প্রতিও সম্প্রতি বাচ্চা-বড় সকলের লোভ তৈরি হয়েছে। এই নতুন ধরনের খাবারটি অবশ্য কোনও দেশি বা বিদেশি ব্র্যান্ডের নয়– একেবারেই দেশিয় স্ন্যাক্স। এর নাম মাখানা। এটি আসলে পদ্মবীজ। ভারতের বড় শহরগুলোর দোকানে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের পট্যাটো চিপস বা অন্যান্য স্ন্যাক্সের প্যাকেট যেভাবে সাজিয়ে রাখা হয়, তার পাশেই এখন শোভা পায় নানা স্বাদের মাখানাও। কয়েক বছর আগেও মাখানা নামটা অপরিচিত ছিল ভারতে। তবে বিহার রাজ্যের মানুষ মাখানা খেতেন আগে থেকেই। কিন্তু তার যে এত পুষ্টিগুণ, সেটা তাদের জানা ছিল না বিশেষ। ভারতের বিহারেই মূলত মাখানা চাষ এবং প্রক্রিয়াকরণ হয়, তবে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলাতেও মাখানা চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
পুষ্টিবিদ মিতালি পালধি বলছিলেন, আদিবাসী এলাকাগুলোতে মাখানা খাওয়ার প্রচলন ছিল, কিন্তু তার বাইরে আমাদের জানাই ছিল না যে এত পুষ্টি আছে মাখানায়। এ নিয়ে বিশেষ গবেষণাও হয় নি। এখন বিজ্ঞানীরা খুঁজে বার করছেন এই মাখানা বা পদ্মবীজের বহু ধরণের পুষ্টিগুণ। সেজন্যই খুব দ্রুত মাখানা স্ন্যাক্স হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
মাখানা চাষের জন্য কম গভীরতার পুকুর বা জল-ভরা চাষের জমি দরকার হয়। মালদা জেলার গ্রামাঞ্চলে দেখা যায় যে অনেক চাষের ক্ষেতেই জল জমিয়ে রেখে মাখানা চাষ করা হচ্ছে। জেলার হরিশচন্দ্রপুর এলাকার এক মাখানা চাষি বোঝাচ্ছিলেন, পদ্মের গোড়া ফেটে গিয়ে বীজ পড়ে থাকে কাদার মধ্যে। সেখান থেকেই পাঁক ছেনে বীজ তুলে আনতে হয়। কালো রঙের ওই বীজ ভেজা অবস্থাতেই পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান। তারপরে সেগুলো চড়া রোদে শুকোতে হয়। তারপরে শুকনো কড়াইতে ভাজতে হয় বীজগুলি। সবশেষে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে মেরে কালো খোলসের ভেতর থেকে সাদা মাখানা বার করা হয়।
এতদিন মাখানার পুষ্টিগুণ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানাই ছিল না। তবে গবেষণা শুরু হতেই উঠে এসেছে এর নানা পুষ্টিগুণ। পুষ্টিবিদরা বলছেন, এক কাপ বা ৩২ গ্রামের মতো মাখানায় ক্যালরির পরিমাণ ১০৬, প্রোটিন থাকে ৪.৯৩ গ্রাম। যেমন এক কাপ মাখানায় ক্যালসিয়াম থাকে ৫২.২ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম পাওয়া যায় ৬৭.২ মিলিগ্রাম আর ফসফরাস থাকে প্রায় ২০০ মিলিগ্রাম। আবার পটাশিয়াম ৪৩৮ মিলিগ্রাম ও আয়রন এক দশমিক ১৩ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়।
পুষ্টিবিদ মিতালি পালধি বলছিলেন, মাখানার মধ্যে নানা ধরণের মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টস আর মিনারেল ভাল পরিমাণে পাওয়া যায়। আরেকটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হল মাখানায় প্রচুর ফাইবারও থাকে। প্রতিদিনের খাবারে ফাইবার থাকলে তা রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রতিদিনের খাবারে ফাইভার রাখা উচিত। এতে যেহেতু ম্যাগনেসিয়াম থাকে, সেটাও হার্টের পক্ষে উপকারী। মাখানা কোলেস্টরল আর ট্রাই-গ্লিসারাইট কমাতে সাহায্য করে, অন্যদিকে এর গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স যেহেতু খুব কম, তাই ডায়াবেটিক এবং প্রি-ডায়াবেটিকদের ক্ষেত্রেও মাখানা খুবই উপকারী। মাখানায় প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে, যেটা ‘এজিং প্রসেস’, অর্থাৎ বুড়িয়ে যাওয়া, চামড়া কুঁচকিয়ে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
মাখানায় যে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে, সেগুলো আবার রিউমাটয়েড আর্থারাইটিস, গাউট, আইবিডির মতো অসুখও নিয়ন্ত্রণ করে। এই সুপার ফুডে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম। তাই হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষাতেও কার্যকরী মাখানা। বহু মানুষ আছেন, যাদের গ্লুটেন অ্যালার্জি আছে, অর্থাৎ আটা, ময়দা খেতে পারেন না। মাখানায় যেহেতু গ্লুটেন নেই, তাই এধরণের মানুষ নিশ্চিন্তে মাখানা খেতে পারেন, পরামর্শ মিতালি পালধির।
মাখানায় বহু পুষ্টিগুণ থাকলেও কয়েক ধরণের মানুষের মাখানা খাওয়া উচিত নয় বলে জানাচ্ছেন পুষ্টিবিদ মিতালি পালধি। তিনি বলেন, এটা যেহেতু একধরণের বাদাম, তাই যাদের বাদামে অ্যালার্জি আছে, তারা মাখানা খাবেন না। কিডনি স্টোন থাকলেও বুঝে শুনে, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে মাখানা খাবেন। এছাড়াও যারা দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাদের উচিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে মাখানা খাওয়া।
স্ন্যাক্স হিসাবেও যেমন খাওয়া যেতে পারে মুড়ি বা বিস্কিটের বদলে, তেমনই আবার স্যুপ, তরকারি কিংবা দুধে মিশিয়েও খাওয়া যেতে পারে মাখানা। মোটামুটি ৩০ গ্রামের মতো মাখানা প্রতিদিন খাওয়া যেতে পারে। কোনও পুষ্টিকর খাবারই যথেচ্ছ পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়– মাখানা খাওয়ার নিয়মও সেটাই। কিন্তু এখনও মাখানা বেশ দামি স্ন্যাক্স হিসাবেই থেকে গেছে। তাই সব শ্রেণীর মানুষের আয়ত্তের বাইরেই রয়ে গেছে মাখানা।