আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো সেনাদের চলে যাওয়ার পর ২০২১ সালের আগস্টে যখন তালেবান ক্ষমতায় ফেরে, তখন তৎকালীন পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, আফগানরা ‘দাসত্বের শিকল ভেঙে ফেলেছে।’ তালেবানরা ২০০১ সালের পর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ফের ক্ষমতা আরোহণ করে। ধারণা করা হচ্ছিল, তালেবানরা ক্ষমতায় আসায় দেশটির ওপর পাকিস্তানের প্রভাব আরও বাড়বে। কিন্তু ‘গভীর কৌশলগত’ এই অঞ্চলে পাকিস্তানের প্রভাব এখন তলানিতে ঠেকেছে। পাকিস্তান এক সময় তালেবানদের পৃষ্ঠপোষক ছিল।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর বিশ্লেষকরা ধারণা করেছিলেন, পাকিস্তান ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবার কাবুলকে পাশে পাবে। কিন্তু তিন বছরেই মধ্যেই পাশার উল্টে গেছে। তালেবান সরকার ভারতকে দীর্ঘ চার বছর পর আফগানিস্তানে দূতাবাস খোলার অনুমতি দিয়েছে। কেবল তাই নয়, তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি দিল্লি সফর করেছেন। ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন। কাবুল-দিল্লি এমন মাখামাখি ইসলামাবাদকে ক্ষুব্ধ করেছে। এরই মধ্যে পাকিস্তান কাবুল পর্যন্ত গিয়ে হামলা চালিয়ে এসেছে। এমনকি শনিবার রাত থেকে পাকিস্তান–আফগানিস্তান সীমান্তে সংঘাত বেঁধেছে। পাকিস্তান আফগানিস্তানের ১৯টি সীমান্তচৌকি দখলের দাবি করেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান একে অপরের ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানের দাবি, তারা আফগানিস্তানের তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাচ্ছে। তালেবান সরকার টিটিপির ‘সন্ত্রাসীদের’ আশ্রয় দিচ্ছে।
ভারত তার কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করে এবং কূটনৈতিকভাবে তালেবান কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি হয় ২০২৪ সালের নভেম্বরে, কাবুলে। সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরান ডেস্কের যুগ্ম সচিব জেপি সিং আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ ইয়াকুবের সঙ্গে দেখা করেন। এক সপ্তাহ পর, তালেবান তাদের প্রতিনিধি হিসেবে ইকরামুদ্দিন কামিলকে নয়াদিল্লিতে মনোনীত করে, যদিও ভারত এখনো কাবুলের বর্তমান শাসকদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। এরপর জানুয়ারির শুরুতে দুবাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ও আমির খান মুত্তাকির বৈঠক হয়। এরপর, চলতি সপ্তাহে ভারত সফর করলেন মুত্তাকি, যা শীর্ষ তালেবান নেতার প্রথম ভারত সফর।
ভারতের সঙ্গে তালেবানের এই ‘ঘনিষ্ঠতা’কে পাকিস্তানের আফগানিস্তান কেন্দ্রিক পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষকরা। পাকিস্তানি দৈনিক দ্য ডন সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘জয়শঙ্করের সঙ্গে মুত্তাকির বৈঠক থেকে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জয়শঙ্কর বলেছেন, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সাধারণ কমিটমেন্ট রয়েছে।’
ভারতের যোগাযোগ বাড়লেও, নয়াদিল্লি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। কিছু পাকিস্তানি বিশ্লেষক মনে করেন, ইসলামাবাদের আপাতত চিন্তার কিছু নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক কিছুই বদলেছে। ভারত গত দুই দশকে আফগানিস্তানে ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তবে আফগান সরকারের প্রধান বাণিজ্য পথ এখনো পাকিস্তান সীমান্ত। আর এই সীমান্তেই টিটিপির তৎপরতা নিয়ে ইসলামাবাদের উদ্বেগ বাড়ছে। ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত টিটিপির সঙ্গে আফগান তালেবানের আদর্শগত বিভাজন আছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সম্পাদকীয়তে ভারত–তালেবান সম্পর্কের সাম্প্রতিক মাত্রাকে ‘বড় অগ্রগতি’ বলে আখ্যা দিয়েছে। তবে সংবাদমাধ্যমটি সতর্কও করেছে যে, এই বাড়তে থাকা সহযোগিতার সঙ্গে একটি উদ্বেগজনক বাস্তবতাও যুক্ত আছে—তালেবান এখনো একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা, যেখানে মানবাধিকার, বিশেষ করে নারীদের অধিকারকে খুব কমই গুরুত্ব দেওয়া হয়। আবার তালেবানের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ না করারও বিপদ আছে। কারণ, চীন ইতিমধ্যেই তালেবানের সঙ্গে বড় ধরনের বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা চুক্তি করেছে। কিন্তু এতে আফগানিস্তানের সমস্যা মিটছে না। কারণ, যতক্ষণ না ইসলামাবাদ তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) নিঃশেষ করতে পারছে, এবং এই কাজে তালেবান সরকারের সহায়তা না পাবে, ততক্ষণ দুই দেশের সীমান্তে এমন সংঘাতের ঘটনা নিয়মিত ঘটার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। এটি কোনোভাবেই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের জন্য সুখকর হবে না।