ঢাকা, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ | ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা

অনলাইন গেমিংয়ে শিশু-কিশোরদের আসক্তি বাড়ছে

অনলাইন গেমিংয়ে শিশু-কিশোরদের আসক্তি বাড়ছে

ফাইল ছবি

মিঠুন সরকার: স্মার্টফোনের সহায়তায় নতুন প্রজন্ম আজ আসক্ত হয়ে পড়েছে অনলাইন গেম নামের এক করুণ নেশায়। ঘরে-বাইরে, রাস্তা-ঘাটে, স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেককে দেখা যায়, পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে গেম খেলছে। মাদকাসক্তির মতোই অনলাইন গেম বর্তমান তরুণদের গ্রাস করে ফেলছে। 

একসময় তরুণেরা অবসর কাটাত বই পড়ে, মাঠে খেলে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমান সংস্কৃতি-সভ্যতার চর্চাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগুলোর জায়গা দখল করে আছে অনলাইনভিত্তিক গেমগুলো। আজকাল লক্ষ করা যায়, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, এমনকি অনার্স পড়ুয়া বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তরুণেরাও অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন; যা এখন শুধু একটি নেশা নয়, মানসিক সমস্যায়ও পরিণত হয়েছে। এই নেশা বা আসক্তির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। 

সাভারের বিদ্যাকানন স্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মেহদীর(ছদ্মনাম) বাবা জানান, তার ছেলে কোন কথা শোনে না। সারাদিন অনলাইনে গেম খেলে। প্রথমে অল্প থাকলেও এখন তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। পড়াশোনায় মন নেই, অদ্ভুত আচরণ করছে। 

দেখাগেছে, অধিকাংশ ভিডিও গেমের কনটেন্ট যুদ্ধ, সংঘাত রক্তপাত নিয়ে। কিশোর-তরুণেরা কল অব ডিউটি, ক্ল্যাশ অব ক্ল্যানস, ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো বিপজ্জনক নেশায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা এবং হাতের নাগালের মধ্যে থাকা ইন্টারনেটের কারণেই এ গেমগুলোর জনপ্রিয়তা অনেক। 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে পাবজি গেমটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ভারত, ইরাক, জর্ডান, চীনে গেমটি বন্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও বিপজ্জনক সব অনলাইন গেম নিষিদ্ধ করার দাবী জানিয়েছে সচেতন মহল। ব্রিটেন, জার্মানি এবং চীনে ভিডিও গেমের আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আলাদা চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। 

রাজধানীর মিরপুরের বাসিন্দা মো: ইমরান খান বলেন, অনলাইনে গেম খেলতে ভালবাসে আমার সন্তান। নিষেধ করলে জিনিস ভাঙছে। মারার জন্য উদ্যত হচ্ছে। মোবাইল নিয়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। আসক্তি ছাড়ানোর জন্য চিকিত্‍সকেরও দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে অনলাইন গেমগুলি বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের দাবি জানাই।।  

অনলাইন গেম আসক্তি অনেককে অনলাইন জুয়ার দিকে ধাবিত করছে। অনলাইন বেটিং প্ল্যাটফর্ম ওয়ানএক্সবেট, মেলবেট, বেটউইনার নামের সাইটগুলো জুয়াড়িদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা পুরো টাকা অ্যাপস পরিচালনাকারীদের কাছে হুন্ডি কিংবা ক্রিপ্টো কারেন্সিতে কনভার্ট করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। 

অনলাইন জুয়ার প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বৃহস্পতিবার (৩১ আগস্ট) রাজধানীতে অনলাইন জুয়ার সাইটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মোহাম্মদপুর, বনশ্রী, আগারগাঁও ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে রেজাউল করিম (৩১), সৈকত রহমান (৩০), সাদিকুল ইসলাম (২৮), নাজমুল আহসান (৩০), তৌহিদ হোসেন (২৫) ও জাকির হোসেন (৩৪) কে গ্রেপ্তারের পর ডিএমপির পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগের দোহাইয়ে যারা অনলাইন গেমে মগ্ন, তাদের ওপর কঠোর নজরদারি এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে ফেসবুকের অপব্যবহার করে এসব চক্র যেসব অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে তা ঠেকাতে হলে কঠোর প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ দরকার। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইটি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান ইমন জানান, অনলাইন গেম আসক্তি প্রতিরোধে শিশু-কিশোরদের প্রতিভা ও মেধা বিকাশে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন-স্কাউটিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গণিত অলিম্পিয়াড, রোবটিং, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি আয়োজন করা যেতে পারে নিয়মিত। 

প্রজন্ম মেডিক্যালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আমজাদুল হক জানান, অনলাইনে গেম খেলার ফলে স্মার্ট ফোনের অধিকমাত্রায় ব্যবহার বাড়ে। মানসিক অস্হিরতা, ঘুমকম(অনিদ্রা), স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, ক্ষুধার ভাব কমে যাওয়া, কাজে অনাগ্রহ, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, এমনকি সামাজিক কার্যক্রম ও কথাবলার মত ইচ্ছা শক্তি কমে যায়। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. জেবউননেছা বলেন, একসময় শিশু-তরুণদের মধ্যে খেলাধূলা, সংস্কৃতি চর্চা ছিল একটি আনন্দের বিষয়। আর এখন ডিভাইস হয়ে গিয়েছে আনন্দের বিষয়। হাত বাড়ালেই মুঠোফোনে পেয়ে যাচ্ছে দুনিয়া। তাছাড়া সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, একক পরিবার, বাবা মায়ের উদাসীনতা সবকিছু অন্যতম কারণ। এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৮৪% এর বেশি মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগ লেখাপড়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এর মধ্যে নারী শিক্ষার্থীদের হার পুরুষ শিক্ষার্থীদের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি। এর বেশিরভাগ অংশ মাসে নিয়ম করে ঘুমাতে যায় না। অনেকেই অনলাইন গেমে সময় বেশি  কাটাচ্ছে। এতে করে তাদের মধ্যে যে কোনো গঠনমূলক কাজে তাদের সম্পৃক্ততা কমে যাচ্ছে। যা খুবই চিন্তার বিষয়।

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান বলেন, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ওয়ানএক্সবেট, মেলবেট, বেটউইনার নামের বেটিং সাইটগুলোতে বাংলাদেশের প্রচুর গ্রাহক বেটিং বা জুয়া খেলায় অংশ নিচ্ছে। রাশিয়া থেকে মূলত এসব অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইট নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বিভিন্ন দেশে স্থানীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষ ম্যানেজার নিয়োগ করা হয়। এদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। 

ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো: নাজমুল ইসলাম বলেন, শিশু-তরুণদের অনলাইনের প্রতি আসক্তি বেড়েছে কয়েক গুণ। অনলাইন গেম বর্তমান তরুণদের গ্রাস করে ফেলছে। কঠোর নজরদারি রয়েছে। কিশোর-তরুণরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের বিপথগামী হওয়ার আগেই সামাজিক আন্দোলন জরুরি।