ঢাকা, শনিবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩০ | ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৫

বেড়েই চলেছে সাইবার অপরাধ প্রবণতা

বেড়েই চলেছে সাইবার অপরাধ প্রবণতা

প্রতীকী ছবি

মিঠুন সরকার: তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণির মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার যত বাড়ছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধও। তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ প্রতিদিনই সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। বর্তমানে সাইবার অপরাধের অভিনব ও বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ই-ট্রানজেকশন, হ্যাকিং ও অনলাইনে প্রতারণা। 

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইবারকেন্দ্রিক আর্থিক অপরাধগুলোর পেছনে বেশ কয়েকটি পক্ষ কাজ করে। এ ধরনের চক্রগুলোকে দ্রুত শনাক্ত করতে না পারলে তারা একই ধরনের অপরাধ বারবার করতে থাকে। এক্ষেত্রে শাস্তি থেকে পার পেয়ে যাওয়া অপরাধীদের দেখে অন্যরাও এসব অপরাধে উৎসাহিত হয়। 

সম্প্রতি আন্ডারগ্রাউন্ড হ্যাকার গ্রুপ সাইবার হামলার হুমকি দেয়। সাইবার ঝুঁকি মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে দুই প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারত। এ লক্ষ্যে উভয় দেশ যৌথভাবে সাইবার সক্ষমতা উন্নয়নের কর্মশালা করতে ঐকমত্য পোষণ করেছে তারা। ২১ আগস্ট ভারতের নয়াদিল্লিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সঙ্গে ইন্ডিয়ান কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিমের (সার্ট ইন্ডিয়া) মহাপরিচালক ড. সঞ্জয় বাহলের দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে এ সিদ্ধান্ত হয়।  

গত ৩ জুলাই একটি হ্যাকার গ্রুপ বাংলাদেশের পরিবহন সেবায় ১ ঘণ্টা হামলার হুমকি দিয়েছিল এবং এসব সেবার ওয়েবসাইট প্রকৃতই হামলার শিকার হয়েছিল।   

২৭ জুন আরেকটি হ্যাকার গ্রুপ বাংলাদেশের সরকারি কলেজের ওয়েবসাইট হ্যাক করে। ২৪ জুন হ্যাকার গ্রুপ বাংলাদেশের একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হ্যাক করে।

৩১ জুলাই ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম জানায়, সাইবার হামলায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো (সিআইআই), ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।  

সরকারের কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (বিজিডি ই-গভ সার্ট) গত বছরের ২০ আগস্ট জানায়, বাংলাদেশে ‘ডি ডস’(ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়েল অব সার্ভিস) সাইবার হামলা দেখা গেছে। 

চলতি বছর সাইবার অপরাধীরা বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠানে মাত্রাতিত হামলার মাধ্যমে ডেটা এনক্রিপ্ট করে। সাইবার নিরাপত্তায় প্রতিষ্ঠান সফোসের সম্প্রতি সেক্টরাল সমীক্ষা প্রতিবেদন-‘দ্য স্টেট অফ র‌্যানসমওয়্যার ইন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড প্রোডাকশন ২০২৩’ থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে ম্যানুফ্যাকচারিং এবং উৎপাদন খাতে র‌্যানসমওয়্যার হামলার মাধ্যমে ৬৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের তথ্য এনক্রিপ্ট (বিশেষ কোড) করেছে তারা। তথ্য এনক্রিপশনের এ হার গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। একই সঙ্গে বৃহত্তর ক্রস-সেক্টরে আক্রমণের প্রবণতাও রয়েছে। ডেটা পুনরুদ্ধার করার জন্য ব্যাকআপ ব্যবহার করা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পরিমাণ বেড়েছে। জরিপ করা ৭৩ শতাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এ বছর ব্যাকআপ ব্যবহার করেছে যা আগের বছর ছিল ৫৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ সরকারের কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (বিজিডি ই-জিওভি সিআইআরটি) এর প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম বলেন, সম্প্রতি একটি হ্যাকার গ্রুপ বাংলাদেশে পেমেন্ট গেটওয়ে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং ব্যাংকগুলোতে সাইবার হামলার হুমকি দেয়। ঝুঁকি মোকাবিলায় সার্বক্ষণিক নেটওয়ার্কের ওপর নজরদারি রাখা হয়। বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী ফাহমিদ আহমেদ বলেন, দেশের ব্যাংকগুলো সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের ব্যাংকে আইটি বিষয়ে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। এ জন্য টেকনোলজি এবং এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান, সচেতনতার ও উন্নতি করতে হবে। নিয়মিত সাইবার অডিট করাতে হবে। শুধু ভালো সফটওয়্যার কিনলেই অথবা তৈরি করলেই হবে না, এগুলো যথাযথ পরিচালনার জন্য দক্ষ কর্মীও তৈরি করতে হবে। 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নুরুল আমিন বলেন, সাইবার হামলার ঝুঁকি প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এটা মোকাবিলায় আমাদের যে প্রস্তুতি তাতে অনেক ঘাটতি আছে। এটা উত্তরণের চেষ্টা না করলে কেপিআই ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। যেসব গোষ্ঠী সাইবার হামলা চালায়, তারা যেসব জায়গায় সাইবার অবকাঠামো দুর্বল সেগুলোকে বেছে নেয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে।  

পুলিশের সাইবার ইউনিটগুলো বলছে, সাইবার অপরাধীরা টর ব্রাউজারের মাধ্যমেও নেট সার্ফিং করে। এই বিশেষ ব্রাউজার ব্যবহারকারীর ইন্টারনেট প্রটোকল অ্যাড্রেস সেভ না হওয়ার ফলে একবার ‘লগ অফ’ করলে ব্যবহারকারীর পরিচয় জানা প্রায় অসম্ভব। অন্যদিকে হোয়াইট ওয়েব (বৈধ) অর্থাৎ গুগল, ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার হলো পুরো নেট দুনিয়ার মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি অংশকে বলা হয় ‘ডিপ ওয়েব’। এই ডিপ ওয়েবের বেশির ভাগ অংশই বেআইনি কাজের ডার্ক ওয়েব। এজন্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সব পুলিশ সদস্যদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের আওতায় আনা জরুরী। 

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, মূল্যবান ডেটা সম্পদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা জরুরী। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ফলে কাগজের তথ্য এখন ডেটায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ডেটা সংরক্ষণ ও  সুরক্ষার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।  

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, সাইবার হামলার হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষা প্রদান করতে হলে সচেতনতাও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কারিগরি সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আর এই কাজটি করতে হবে সম্মিলিতভাবে। কোনো দেশই একা একা নিজেদের ন্যাশনাল সাইবার স্পেস নিরাপদ রাখতে পারবে না। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সাইবার নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখা সম্ভব নয়।