ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ | ১২ বৈশাখ ১৪৩১ | ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

একজন ওসির বদলিতে কাঁদলেন সবাই

একজন ওসির বদলিতে কাঁদলেন সবাই

ছবিঃ: গ্লোবাল টিভি

আমিনুল ইসলাম জুয়েল, পাবনা :  পাবনার আতাইকুলা থানার ওসি জালাল উদ্দিনকে বদলি করা হয়েছে। তিনি  পাবনার চাটমোহর থানায় যোগদান করেছেন । তবে মাত্র ১৪ মাস আতাইকুলা থানায় সরকারি দায়িত্ব পালন করতে এসে তিনি আতাইকুলা থানার সর্ব শ্রেণির মানুষের মন জয় করে গেলেন। তাই তার বদলির কথা শুনে অনেকেই চোখের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। যাবার বেলায় ওসি জালালও ছিলেন অশ্রসিক্ত। 

আতাইকুলা থানার ওসি (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম জানান, ওসি হিসেবে আসার পর জালাল উদ্দিন অল্প কিছুদিনেই আতাইকুলা বাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। যখনি কোথাও কোনও সংকট দেখেছেন তিনি ছুটে গেছেন। পাশে দাঁড়িয়েছেন সবার বিপদ-আপদে। তিনি বলেন, অল্প কয়েকমাস স্যারের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে তার সততা, কর্মনিষ্ঠা, মানবিকতায় আমি মুগ্ধ। তিনি বিভাগীয় নির্দেশরা যেভাবে বাস্তবায়ন করেন তা অনুকরণীয়। তিনি জানান, জালাল স্যারের বদলিজনিত বিদায়টা বেশ কঠিন ছিল। এ সময় সহকর্মীরা ছিলেন অশ্রুসজল। 

এলাকার সাধারণ জনগণও তার কাজে মুগ্ধ ছিলেন। গাঙ্গহাটি গ্রামের ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আবু সাঈদ জানান, তাদের গ্রামে গত বছর অতি বর্ষণে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এক ব্যক্তি পানি নিষ্কাশন পথ আটকে দেয়ার কারণে ৫০- ৬০ বিঘা জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। গ্রামে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। আবু সাঈদ জানান, ওসিকে জানানোর পর তিনি নিজে এসে সমাধান করে দেন। পাইপ দিয়ে পানি নিষ্কাশণের উপায় করে দেন। যেসব পরিবার টাকা দিতে সমর্থ ছিলেন না, তিনি তাদের টাকা নিজের পকেট থেকে দিয়েছিলেন। আবু সাঈদ জানান, ওসি এসে টাকা নিয়ে যাবেন বলে তাদের ধারণা ছিল অথচ ওসি উল্টো টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। আবু সাঈদ জানান, ওসি সাহেবের বদলির কথা শুনে তার মনটা খুব খারাপ।

একই রকম কথা বললেন কৈজুরি শ্রীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মোয়াজ্জিন এবং নাইট গার্ডদের দলপতি আমজাদ হোসেন খাদেম(৫১)। তিনি বলেন, প্রতিটি রাতে ওসি স্যারের সাথে কথা হত। রাতে গাড়ি নিয়ে টহল দিতেন তিনি। বাজারে তাদের সাথে কথা বলতেন। সুবিধা-অসুবিধার কথা শুনতেন, তাদের পরামর্শ দিতেন। এই ওসি বদলি হওয়াতে অফাপনার কেমন লাগছে প্রশ্ন করায় আমজাদ হোসেন জানালেন, ‘নিজের অজান্তেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়েছে। 

চরপাড়া গ্রামের নায়েব আলী, আবুল কালাম আজাদ, আখতার হোসেন, আজিবর রহমানসহ অনেকে জানালেন তাদের গ্রামে আগে এক বছর আগে প্রত্যেকের গোয়াল ঘরে চৌকি পাতা ছিল। কারণ তাদের গ্রাম থেকে প্রায় রাতেই গরু চুরি হত। এজন্য তারা বাধ্য হয়ে গোয়াল ঘরে রাত যাপন করতেন। কিন্তু ওসি জালার উদ্দিন গত বছরের এপ্রিল মাসে যোগদানের পর থেকে গরু চুরি শতভাগ বন্ধ হয়ে যায়। তারা এমন ওসির বদলির কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছেন বলে জানালেন।

আতাইকুলা এলাকার মো. বাবু, মো: মানিকসহ বেশ কয়েকজন ভ্যান চালক জানালেন, ওসি জালাল আসার পর থেকে তারা চাঁদাবাজি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তাদের কষ্টের কথা শুনে সড়কে কোন চাঁদাবাজি হতে দেননি। সুধী সমাজেও তিনি সমান জনপ্রিয় ছিলেন। স্থানীয় সংবাদকর্মী কামরুল ইসলাম জানান, এমন মানবকি গুণসম্পন্ন ওসির কথা ভোলা যায় না। পাবনা প্রেসক্লাবের সাবেক সিনিয়র সহ- সভাপতি আখতারুজ্জামান আখতার বলেন- ওসি জালালের চেহারাটাও ভাল, তার মন এবং কাজও ভাল। তিনি সবার বিপদ আপদে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে।

বনগ্রাম বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম জানান, জেলার বিখ্যাত হাট বনগ্রামে এক সময় বাজারে চুরি হত। কিন্তু ওসি জালালের যোগদানের পর বাজারে কোন চুরির ঘটনা ঘটেনি। সৎ এবং কর্মঠ একজন পুলিশ অফিসার জালাল উদ্দিন। এমন ওসি-ই তো আসলে জনগণ চান। বামনডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা জহুরুল ইসলাম জানান, তিনি একবার বিপদে পড়েছিলেন। ওসি জালালকে জানানোর সাথে সাথে তিনি তাকে সহযোগিতা করেন। এটি ভুলবার নয় বলে জানান। তিনি খুব অল্প দিনেই বদলি হয়ে যাওয়ায় কষ্ট লাগছে । 

ওসি জালাল আক্ষরিক অর্থেই সেরা ওসি ছিলেন। তিনি এক বছরের কর্মকালে পাবনা পুলিশ সুপারের অফিস থেকে দু’বার সেরা ওসির সম্মাননা লাভ করেন।  

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময় সন্ত্রাস কমে গেলেও মাদকে ভরে যায় গোটা আতাইকুলা থানা এলাকা। গ্রামে-গ্রামে মুড়ি মুড়কির মতো মাদক কেনাবেচা হয়। পাড়ায়-পাড়ায় চলত জুয়ার আড্ডা। অনেকেই অভিযোগ করতেন কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মাদক কারবারিদের সখ্যতা থাকায় অবস্থা লাগামহীন ছিল। তবে ওসি জালাল আসার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। 


আতাইকুলার থানা ভবনের পাশে প্রবীণ শিক্ষক আব্দুল বাতেনের বাসা। তিনি জানান, আতাইকুলা থানা প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এত কর্মদক্ষ ওসি তিনি দেখেননি। তার ছেলে ঠিকাদার মানিকুজ্জামানও জানালেন একই রকম কথা। বলেন, জনপ্রত্যাশা পূরণে এ ওসির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়।

ওসি জালাল আসার পর আতাইকুলা থানায় দালালদের দৌরাত্ম্য ছিল না। থানায় সেবা নিতে আসা মানুষের ভোগান্তি ছিল না। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন মসজিদে গিয়ে পর্যন্ত মানুষকে জানিয়েছেন পুলিশ জনতার বন্ধু। তারা তাদের যে কোনো আইনি সহায়তায় পুলিশের কাছে যেন নি:সংকোচে যান। যারাই এ ওসির কাছে গিয়েছেন তাদেরই ধারণা পাল্টে গেছে। পুলিশ জনতার বন্ধু তার প্রমাণ  এ এলাকার জনসাধারণ পেয়েছেন বলে সেবাপ্রাপ্তরা জানান।

বিদায়ী ওসি জালাল উদ্দিন বলেন, আতাইকুলা থানায় যে কাজ করেছি তা সবই সম্ভব হয়েছে এলাকার মানুষ ও সহকর্মীদের সহায়তায়। তিনি জানান, পাবনা পুলিশ সুপারের দিক নির্দেশনা তাকে উদ্দীপ্ত করেছে। তিনি পুলিশ সুপারের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, যে কাজটি করেছি আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততার সাথে করার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, বদলি তো চাকরিরই অংশ। তবে আতাইকুলাবাসীর মন জয় করতে পেরেছি এটাই তো বড় পাওয়া।

এএইচ