ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪ | ৫ বৈশাখ ১৪৩১ | ৮ শাওয়াল ১৪৪৫

ক্বারী আমীর উদ্দিনের গান:: ভাবসংগীত ও মরমিসংগীতের ধারা

ক্বারী আমীর উদ্দিনের গান:: ভাবসংগীত ও মরমিসংগীতের ধারা

ক্বারী আমীর উদ্দিন

তপন বাগচী : ‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’ আরিফ দেওয়ানের গাওয়া এই গানটি বাংলাদেশ বেতারে অজস্রবার শুনেছি। গানটি কে লিখেছে, তা জানার সুযোগ পেয়েছি অনেক পরে। ধরেই নিয়েছিলাম যে এটি কোনো সাধক গীতিকবির রচনা! চাঁদ আর বন্ধুর প্রতীক-রূপকে এই যে গানের বাণী, তা কেবল আমাদের সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ লোককবিদেরই সাধনার ফসল। এরপর শিল্পী আরিফ দেওয়ানের কণ্ঠে শুনেছি ‘আমি পাইলাম না দরদিয়া শ্যাম’ গানটি। বন্ধু ও সংগীত-গবেষক শাকির দেওয়ানের কাছ থেকে জেনেছিলাম এই দুটি গানেরই গীতিকার ক্বারী আমীর উদ্দিন আহমদ। শিল্পী আরিফ দেওয়ানের কাছে শুনেছি তাঁর গানের কথা, তাঁর ব্যক্তিজীবনের কথা। ক্বারী আমীর উদ্দিনের প্রতি আমার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকে বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে তাঁর গান শুনেই।

ক্বারীয়ানা পরীক্ষায় পাস করে ‘ক্বারী’ উপাধি অর্জনকারী সুনামগঞ্জের আলমপুর গ্রামের রওশন আলী থেকে ক্বারী আমীরউদ্দিন আহমদ হয়ে-ওঠা, মসজিদের ইমাম থেকে আজ লন্ডনপ্রবাসী শিল্পী ও সমাজসেবী হয়ে-ওঠা কিংবা গ্রামের মজলিসে শখের শিল্পী থেকে দেশ-বিদেশের মঞ্চে গান গাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের পেছনে যে গুণটি ক্রিয়াশীল তা হলে সাধনা এবং নিরন্তর সাধনা। সেই সাধনা তিনি সুদূর প্রবাসে বসেও চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি আমাদের জন্য খুবই আশার কথা।

তপন বাগচী

১৯৪৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া এই গীতিকবির পিতার নাম শাহ মুহাম্মদ রুস্তম আলী শেখ, মাতার নাম আলিফজান বিবি। তাঁর পূর্বসুরীরা ফকিরি ধারার লোক ছিলেন। পিতা-মাতার মতো সংগীতের অনুরাগ তাঁর রক্তেই প্রবাহিত ছিল। ছোটবেলায় গান গাইতেন ঘরে ও বাইরে। পিতার সায় ছিল তাতে। বলা যেতে পারে পিতার প্রেরণাতেই গানের ভুবনে আসা। ছোটবেলা থেকে বাঁশি, কাঁসি, ঢোল, একতারা, বেহালা, হারমোনিয়াম ও তবলা বাজানো আয়ত্ব করলেন অন্যের বাজনা দেখে-দেখে শুনে-শুনে। এই সময় তিনি গাইতেন সিলেট অঞ্চলের হাসন রাজা, রাধারমণ, দ্বিজদাস ঠাকুর, সৈয়দ শাহনুর, আরকুম শাহ, শীতালং শাহ, দুর্বিন শাহ, মওলানা ইয়াসিন প্রমুখ পূর্বসূরী মহাজনের গান। ষাটের দশকের শুরু থেকে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন হন এবং নিজেই গান রচনা শুরু করেন। দেখতে দেখতে তাঁর গানের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এ বড় গৌরবের কথা! বড় আনন্দের কথা! বাংলা গানের পালে যেন নতুন হাওয়া!

গীতিকার ক্বারী আমীর উদ্দিন আহমদ একসময় পালাগান করতেন রাত জেগে। পালার আসরে মালজোড়া গান করতেন তিনি। প্রতিপক্ষ শিল্পীকে ঘায়েল করতে তাঁর জুড়ি ছিল না তখন। কামালউদ্দিন, শাহ আব্দুল করিম, দুর্বিন শাহ, আবেদ আলী, কফিলউদ্দিন, রজ্জব আলী দেওয়ান, আব্দুর রহমান বয়াতি প্রমুখ শিল্পীর সঙ্গে একই আসরে প্রতিপক্ষ সেজে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। সিলেট অঞ্চলে তাঁর প্রচুর ভক্ত-শিষ্য। একসময় তিনি প্রবাসজীবন বেছে নেন। কিন্তু গানের নেশা তাঁকে ছাড়েনি। এখনও নিয়মিত গান রচনা করছেন, সুর সংযোজন করছেন এবং কণ্ঠ দিচ্ছেন। দেশের বিখ্যাত শিল্পীদের মধ্যে রুনা লায়লা, আরিফ দেওয়ান, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, ফকির শাহাবুদ্দীন, রণেশ ঠাকুর, বেবী নাজনীন, অণিমা মুক্তি গমেজ, মমতাজ বেগম, আসিফ আকবর, কাজল দেওয়ান, শাহনাজ বেলী, আশিক, রেশমা সুইটি তাঁর গান করেন। সুনামগঞ্জের শিল্পী দেবাদাস চৌধুরী, তুলিকা ঘোষ চৌধুরী, রশিদউদ্দিন, তছকির আলী, ইকরামউদ্দিন, সিরাজউদ্দিন প্রমুখ শিল্পীর কণ্ঠে ক্বারী আমীর উদ্দিনের গান এখনও গীত হয়ে চলছে। এছাড়া এলাকায় যাঁরা বাউলগান খুঁজছেন তাঁদের কাছেও আকর্ষণীয় তাঁর গান। নতুন শিল্পীদের অনেকেই গাইছেন তাঁর গান।

‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’ গানটি ছাড়াও তাঁর জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে, ‘শাহজালালের পূণ্যভুমির নাম জালাল শরীফ’, ‘হেলায় হেলায় দিন ফুরাইলো সই’, ‘মন কারিয়া নিলো গো প্রাণ কারিয়া নিলো সখি’, ‘মায়া লাগাইয়ারে বন্ধু এতো লাঞ্ছনা’, ‘যদি ভালবাস না, কাছেও আস না , দেখেও দেখো না, কোনো দিন’, ‘শিখাইয়া পিরিতি করিল ডাকাতি’, ‘আগে ভক্তির চুলা বানাও, সবুরের হাঁড়ি বসাও’, ‘আমারে খুজিয়া দেখি আমি নাই’, ‘কে এমন চাঁদরূপসী, জাদুভরা মুখের হাসি’ প্রভৃতি মানুষের মুখে-মুখে ফেরে। ক্বারী আমীর উদ্দিনের গান নিয়ে ‘গুলজারে মা আরেফাত’, ‘বিরহের উচ্ছ্বাস’, ‘প্রেমের জগত’, ‘পরশমণি’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ‘আমীরী সংগীত’ বেরিয়েছে ২ খণ্ডে। এবার প্রকাশিত হলো তৃতীয় খণ্ড। এভাবে তাঁর সকল গান প্রকাশিত ও গ্রন্থিত হলে বাংলা মরমি গানের ধারার সমৃদ্ধি অনুভব করা যাবে। আমরা সেই অপেক্ষায় রয়েছি।

বাংলা লোকসংগীতে মরমি ও আত্মনিবেদনের বাণীতে ভরপুর থাকে। ক্বারী আমীর উদ্দিনও তাঁর ব্যতিক্রম নন। সহজাত চেতনায় সহজিয়া জীবনদর্শন ফুটে ওঠে তাঁর প্রায় প্রতিটি গান। তাঁর একটি গানে আছে-
‘আমি যাহা বুঝি না গো তুমি বুঝাইবায়নি
তোমার গান গাইতে দিবায়নি
আমার এই ফরিয়াদ তোমার চরণে রাখবায়নি॥

দয়াল গো... ভাষাজ্ঞান নাই যে আমার
নিবেদন শুনবায়নি।
দূর করিয়া দীলের আঁধার, দীদার দেখাইবায়নি॥’
যাঁর গুণকীর্তন করার জন্য মন ব্যাকুল, তাঁর কাছে তোর সুর ও কথার শক্তি বাঞ্ছা করার এই নিবেদন তাঁর এই গানে জলদ কাহারবা তালে ফুটে উঠেছে। দাদরা তালে বাঁধা তাঁর আরেকটি গানে আছে-
‘আমি যেন সকল সময়, দেখি তোমার জ্যোতি
এই তো আমার সোনা চুনি, পান্না হীরা মোতি॥

শয়ন স্বপ্ন জাগরণে, মন চলে যে তোমার টানে
আমীর উদ্দিন তোমার গানে, নেয় না যে বিরতি॥’
গানই জীবন, গানই আমীর উদ্দীনের সাধনার অঙ্গ। গান থেকে তিনি বিরতি নিতে চান না। গানে গানেই তিনি সাধনা চালিয়ে যেতে বাসনা করেন। তিনি যখন বলেন, ‘আমার অযোগ্য অচেতন আত্মায়, দাও হে চৈতন্য করি’, তখন বাঙালির ভাবসাধনার মরমিয়া ধারায় তিনি লীন হয়ে পড়েন। শ্রীচতৈন্যের ষোড়শ শতকের ভাবান্দোলনের প্রভাব তো শ্রীহট্টের গানে থাকাটাই স্বাভাবিক।
আমরা দেখতে পাই তাঁর পরম আরাধ্য ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণী তিনি প্রচার করেছেন গানে-গানে-
‘ছায়্যিদিনা মোহাম্মদ আমার নবী
সৃষ্টিতে যার সকল প্রাণের দাবি
সে জন আমা নবী।’
আমীর উদ্দিনের গানে আমাদের ধর্মচেতনা যেমন আছে তেমনি দেশচেতনায় আছে। বাউলদর্শনও প্রতিভাত হয়েছে তাঁর গানে। হাসন রাজাও ‘বাউলা কে বানাইলা রে’ বলে নিজেকে বাউল বলে পরিচয় দিয়েছেন। শাহ আবদুল করিম তাঁর গানের ভণিতায় ‘বাউল আবদুল করিম বলে’ উল্লেখ করেছেন। তাই এঁদেরকে অনেকই ‘বাউল’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এটি কতটা যুক্তিসঙ্গত আর কতটা ভাবাবেগপ্রসূত, তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে।

কিছুদিন আগে ‘পরিবর্তনডটকম’ নামের একটি ইন্টারনেট ম্যাগাজিনে পশ্চিমবঙ্গের ‘দোহার’ ব্যান্ডের শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাটিয়ালি বা ভাওয়াইয়ার একটা নিজস্ব ঢং আছে, বাউল গানের নিজস্ব সুরের কোনো ঢং নেই। রবীন্দ্রনাথের বাউল-আঙ্গিক গানের কথা অনেক পণ্ডিত বলেন, এটা কিন্তু ভুল বলা।’ এর বিপরীতে আমার বক্তব্য হলো, দীর্ঘদিনের সেবায় বাউলগানেরও নিজস্ব সুরের ঢং তৈরি হয়ে গেছে। আমরা সংগীতমূর্খরা তা বুঝতে পারি, কালিকাপ্রসাদের মতো সংগীতজ্ঞরা তা যে কেন বুঝতে চাইলেন না, তা এক রহস্য বৈকি! রবীন্দ্রনাথের বাউল-আঙ্গিক গানের কথা যে পণ্ডিতরা বলেন, তারা মোটেও ভুল বলেন না। কালিকাপ্রসাদের বলাটাকেই তো আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘বাউল-অঙ্গের দর্শন হতে পারে, সুর হতে পারে না।’ এতো সেই সেকেলে ধারণা। বাংলা তো ভাষার নাম। তাহলে বাংলা কি ভাষার নামই থাকবে, দেশের নাম হতে পারবে না? আমরা তো বাংলা নামে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ গঠন করেছি ‘বাংলাদেশ’ নামে। পশ্চিমবঙ্গ এখন তো প্রদেশের নাম রেখেছে ‘বাংলা’। তাহলে বাংলা নামে ভাষা হয়, ভাষার নামে দেশ হয়, দেশের নামে প্রদেশও হয়। তেমনি বাউল অঙ্গের দর্শন যেমন হয়, সেই দর্শন প্রতিফলিত হয় যে গানে, সেই গানের সুরকে ‘বাউলসুর’ নামে চিনতে আমাদের কষ্ট হয় না। তিনি বলেছেন, 'শাহ আব্দুল করিম বাউল ছিলেন।’ বাউল-জীবনাচরণের একটি বৈশিষ্ট্যও কি তিনি খুঁজে পেয়েছেন? করিমের গানে খুঁজলে বাউল-দর্শন পাওয়া যায়, ভণিতায় ‘বাউল’ শব্দের উল্লেখ আছে, তাই বলে তাকে বাউল বলা ঠিক নয়।

বাউলকে হতে হয় গৃহত্যাগী, সংসারবিরাগী। শাহ আবদুল করিম তো সেই পথ বেছে নেননি। তিনি সংসারী, গৃহী তো ছিলেনই, রাজনীতিও করেছেন। আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির একজন নেতাও ছিলেন। এরকম বৈষয়িক মানুষকে কেন যে ‘বাউল’ বানানো হচ্ছে, বুঝতে পারলাম না। বাউল একটা জীবনদর্শন, একটা জীবনাচারের নাম, একটি সাধনকেন্দ্রিক লোকধর্মের নাম। তাঁরা সাধনসঙ্গী গ্রহণ করে, বিয়ে করে না, সন্তান উৎপাদন করে না। তারা আগামী জীবনের জন্য সঞ্চয় করে না। ভিক্ষান্নে জীবন চালায়। আমার চেয়ে তিনি এ বিষয়টি ভালো জানেন। হাসন তো তাঁর ‘বাউলা কে বানাইলো রে..’ বলে তার মুর্শিদের সন্ধান করেছেন? তাহলে কি হাসান রাজাকেও বাউল বলবেন? আলফু দেওয়ানের গানের ভেতরেও তো বাউলদর্শন খুঁজে পাই। কিন্তু তাকে তো কেউ বাউল বলছি না। আমি তপন বাগচী বাউলদর্শন সামনে রেখে গান লিখেছি। তাহলে আমাকেও কি বাউল বলবেন? শাহ আবদুল করিম অন্তরে বাউলের চিন্তা ধারণ করেছেন হয়েতা, কিন্তু জীবনাচারে বাউল ছিলেন না। তাই তাঁকে ‘বাউল’ বলে বড় করতে গিয়ে প্রকারান্তরে তাঁকে ছোট করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

কালিকাপ্রসাদ আরো একটা কথা বলেছেন, ‘লালনের গান ছাড়া প্রামাণ্য প্রায় কিছু নেই। যা ভাবা হয়, তার সবটাই কল্পনা।’ তাহলে লালনের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ‘হিতকরী’ পত্রিকায় যে রচনাটি প্রকাশিত হয়, তাতো লালনকে দেখেছেন এমন কোনো জীবিত লোকেরই লেখা। এগুলোই তো প্রামাণ্য হিসেবেই বিবেচিত। এখন নতুন বিতর্ক তোলার উদ্দেশ্য মহৎ হতে পারে না। ওই সাক্ষাৎকারে তাঁর বক্তব্য লালনের পাশাপাশি শাহ আবদুল করিমকে দাঁড় করানোর একটা অপচেষ্টা মাত্র। লালন সাঁই আর শাহ আবদুল করিম দুজনেই আমাদের সংগীতজগতের পৃথক স্তম্ভ। কেউ কারো প্রতিপক্ষ নয়। শাহ আবদুল করিমকে এখন দেখছি ‘বাউলসম্রাট’ বলারও চেষ্টা করা হচ্ছে। কথাগুলো এ কারণে বলা হলো যে ক্বারী আমীর উদ্দিনকেও ‘বাউল’ এবং ’বাউলসম্রাট’ বলা হচ্ছে। তাঁর প্রতি ভক্তির নিদর্শনস্বরূপ ভক্তরা এই উপাধি দিচ্ছেন। তিনি মরমি কবি, মারফতি কবি, তিনি সুফি কবি, তিনি বাউলকবি, কিন্তু ‘বাউল’ বলা ঠিক নয়।

আমাদের ভাবতে হবে, বাউলচেতনা গানে থাকলেই কি কেউ বাউল হয়ে যায়। বাউল হতে গেলে তো তাঁকে এই লোকধর্মে দীক্ষিত হতে হয়। ঘর-সংসারের আশা ত্যাগ করতে হয়। কিন্তু সেই সব বাউলধর্মীয় আচরণ না করেও বাউলগান লেখা যায়। যেমন রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধদর্শন নিয়ে অনেক গান লিখেছেন, তার জন্য তো তাঁকে বৌদ্ধ বলা যাবে না। বাউলগান লিখলে বা গাইলে তাঁকে ‘বাউলগানের শিল্পী’ বলা যায়। যেমন রবীন্দ্রনাথের গান গাইলে ‘রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী’, নজরুলের গান গাইলে ‘নজরুলসংগীতশিল্পী’, তেমনি ‘বাউলসংগীতশিল্পী’ বলা যেতে পারে। এখন ক্বারী আমীর উদ্দিনের গান গাইলে তাঁকে ‘আমীরিসংগীতশিল্পী’ বলা যেতে পারে। হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম, ক্বারী আমীর উদ্দিন নিজেকে বাউল বলেছেন আদর্শিক চেতনাগত বিশ্বাস থেকে। সেই কারণে তাঁদেরকে ‘বাউল’ বলা হলে কোনোমতেই তাঁদের গুরুত্ব বেড়ে যাবে না। বরং এঁরা স্বনামেই প্রকাশিত হওয়ার যোগ্য। ‘বাউল’ বিশেষ তাঁদের জন্য বাহুল্য বলেই আমার ধারণা। রাধারমণ দত্ত, হাসান রাজা, আরকুম শাহ, দুরবীন শাহ, জালালউদ্দিন, শাহ আবদুল করিম প্রমুখের ধারায় ক্বারী আমীর উদ্দিনকে আমরা ‘মরমি কবি’ আখ্যা দিতে পারি। ‘আমীরিসংগীত’ তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের মুহূর্তে আমার এই বিশ্বাসের কথা বলে রাখলাম।


ক্বারী আমীর উদ্দিনের অনেক গান এখন বিকৃতির কবলে। এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। তাঁর ‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’ গানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছে আরিফ দেওয়ান, অণিমা মুক্তি গমেজ, মমতাজ বেগম, আশিক প্রমুখ জনপ্রিয় শিল্পীর কণ্ঠসুধার জন্য। একথা বললে গীতিকারের অবদানকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। ‘চাঁদ নয়, আমার বন্ধু এসেছে’ বলে বিপরীত তুলনার মাধ্যমে যে দ্বান্দ্বিক প্রতিমা সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সত্যিই চমৎকার। গানে মরমি সুরটিও সূক্ষ্মভাবে রয়েছে। পূর্ণ গানটি এখানে তুলে ধরা যায়-
লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে
না গো না, চাঁদ নয়, আমার বন্ধু এসেছে॥

বিশ্বাস করে না ওরা অবিশ্বাসী মন
তবুও কয় দেখিতেছি চাঁদেরি কিরণ
(আমি) ডাক দিয়ে কই এসো না, নিজের চোখে দেখো না
হৃদয় সিংহাসনে আমার, কে বসেছে!

কপালপোড়া আমার ডাকে সাড়া নাহি দিলো
পূর্বাপর ভাল বটে, দু-একজন আসিলো
(ওরা) রূপ দেখিয়া বলে রে ভাই, এই রূপের তুলনা নাই
কোটি চাঁদের তরণতলে (যারে) ধরা দিয়েছে॥

নগরবাসী বেহূঁশ হইয়া, ঘুমে নাক ডাকায়
আমীর উদ্দিন প্রেমের ভাবে রূপের মূর্তি চায়
ভক্ত যারা দিয়া প্রাণ, গাহে বন্ধুর জয়গান
সখিগণে বন্ধুয়ারে সেবা দিতেছে॥
কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করছি গানটি ক্রমশ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। ক্বারী সাহেবের সুরে এই গানটি বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলেন আরিফ দেওয়ান। তিনি মঞ্চে ও টেলিভিশনেও অজস্রবার গানটি পরিবেশন করেছেন। এটি একসময় আরিফ দেওয়ানের গান হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু ক্বারী সাহেবের কাছ থেকে প্রাপ্ত বাণী থেকে আরিফ দেওয়ানের কণ্ঠে শ্রুত গানে দু-একটি শব্দের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। পরে মমতাজ, আশিক, রেশমা সুইটির কণ্ঠেও এই গানের কথা বদলে যেতে শুনেছি। এঁদের কণ্ঠে যেটুকু বাণীবদল ঘটেছে, তাতে ভাব ঠিক আছে এবং বাক্যপুনর্বিন্যাসের বাইরে বেশি দূর যায়নি। ‘নগরবাসী’ স্থানে ‘পাড়াপড়শী’, আর ‘পূর্বাপর ভাল বটে’ স্থলে ‘ভাগ্য ভালো পূর্বপুরুষ’ হয়তো বাণীর লিখিত রূপ হাতে না পাওয়ায় এবং শুনে শুনে শিখতে গিয়ে এই বিচ্যুতি ঘটেছে। এটি কখনোই আমাদের কাম্য নয়। সুরকার অনেক সময় গীতিকারের সঙ্গে আলাপ করে এরকম কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু এখানে গীতিকার ও সুরকার একই ব্যাক্তি বিধায় এটি করার সুযোগ ঘটেনি, তা সহজেই অনুমেয়। মূল বাণী হাতে পেলে তাঁরা এই বিকৃতি শুধরে নিতে পারবেন বলে আমার ধারণা। এর জন্য শিল্পীদের এগিয়ে আসার দায় আছে। তাঁরাও মূল বাণী খুঁজে নেওয়ার কষ্টটুকু করতে পারেন।

‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’ গানটি নিয়ে ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে এর সুর আর আস্থায়ী ঠিক রেখে ভেতরে বাণী বদলে দিয়ে। বেবী নাজনীন এই গানটি চমৎকার গায়নশৈলী দিয়ে পরিবেশন করেন, একথা সত্যি। একই সুর, একই অস্থায়ী, একই ঢঙে এটি অনেক জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী বিভিন্ন মঞ্চে ও টেলিভিশনে পরিবেশন করেছেন। আমার মতো অনেকের কর্ণে লেগে আছে বেবী নাজনীনের সুর। সংগীতপিপাসু অনেকেই মনে করতে পারেন যে এটা আমীর উদ্দিনেরই লেখা গান। গানটির আস্থায়ীর প্রথম চরণে ‘উঠেছে’ বদলে দিয়ে ‘এসেছে’ লেখা হয়েছে। পুরো গানটি তুলে ধরছি তুলনা করে বোঝানোর জন্য- 
লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ এসেছে
না গো না, চাঁদ নয়, আমার বন্ধু এসেছে॥

বৃষ্টি হইলে আকাশ মাটির হয়ে যায় মিলন
হিয়ার মাঝে দেখলাম আমি চান্দেরও কিরণ।
হয় না রূপের তুলনা
পাই না খুঁজে উপমা
লক্ষ কোটি চাঁদের আলোর উদয় হয়েছে॥

‘পথিক খোজে পথের দিশা চড়ই খুজে খড়
তোমার চোখে খুঁজি আমি ভালবাসার ঘর।
বিশ্বাস না হয় এসো না
নিজের চোখে দেখ না
হৃদয় সিংহাসনে আমার কে বসেছে॥’
এই বাণীটিও সুন্দর। কিন্তু আপত্তির জায়গা হলো ভাব তো বটেই আস্থায়ীর পুরোটা এবং দুটি অন্তরার অন্য চরণও হুবহু মিলে যায় ক্বারী আমীর উদ্দিনের গানের বাণী থেকে। সুর তো হুবহু এক। এর জন্য বেবী নাজনীনকে দোষ দিতে গিয়েও দিতে পারছি না। কারণ তিনি তো গান লেখেননি এবং সুর করেননি। ইন্টারনেট খুঁজে দেখতে পেলাম, ১৯৯৯ সালে মমতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত মান্না-শাহনাজ অভিনীত ‘লাঠি’ চলচ্চিত্রে এই গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে গীতিকার হিসেবে কবির বকুল আর সুরকার হিসেবে শওকত আলী ইমনের নাম রয়েছে। চলচ্চিত্রে ব্যবহারের পরে এই গানটি অনেক শিল্পীর মুখেই শোনা যায়। বাংলাদেশের যাত্রাগান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমি গ্রামীণ যাত্রার আসরেও এই গান শুনেছি। সুর ক্বারী আমীর উদ্দিনের, স্থায়ীর পুরোটা, দুই অন্তরার অর্ধেক করে আমীর উদ্দিনের। বাকিটা অন্য কারো। লজ্জা প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমাদের।

এ মরমি কবি ক্বারী আমীর উদ্দিন জীবিত থাকতেই যদি তাঁর গানের এরকম বেহাত হয়, তবে প্রায়ত মহাজনদের গানের অবস্থা কী হবে, তা সহজেই অনুমেয়। এই নিয়ে আরিফ দেওয়ানের প্রতিবাদ এবং ক্বারী আমীর উদ্দিনের বিবৃতিও কোনো ফল দিতে পারিনি। আমরা আশা করবো, এই সুরে কেউ গাইলে মূল গানটিই যাতে খুঁজে নেয়া হয়, তাতে প্রকৃত অর্থেই সংগীতের প্রতি ভালবাসা জানানো হবে। আর তাই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আমীর উদ্দিনের গানের বাণী ও সুর সংরক্ষণের। তারই একটি বড় পদেক্ষপ এই ‘আমীরিসংগীত’ গ্রন্থমালার প্রকাশনা। এই উদ্যোগকে আমি আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। পর্যায়ক্রমে তাঁর সকল গান গ্রন্থিত হোক, বাংলাভাষী পাঠেেকর কাছে তা পৌঁছে যাক, এই শুভকামনা জানাই।


তপন বাগচী: লেখক ও গবেষক


এসএনএ